বিজ্ঞাপন

কাগজে-কলমে শেষ, বাস্তবে শুরুই হয়নি কাজ!

July 6, 2022 | 8:05 am

জিএম শান্ত, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

বরিশাল: প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামতের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাগজে-কলমে নামমাত্র কাজ দেখিয়ে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী এ প্রকল্পের কাজ ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে কোনে স্কুলেই কাজ শুরু হয়নি। এ অনিয়মের সঙ্গে শিক্ষা অফিসের কিছু কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে মাইনর (ক্ষুদ্র) মেরামতের জন্য ৮৩টি বিদ্যালয়ের বিপরীতে ২ লাখ টাকা করে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। কাগজে-কলমে বিদ্যালয়গুলোতে মেরামত প্রকল্পের সব কাজই সমাপ্ত দেখানো হয়েছে। অথচ অধিকাংশ বিদ্যালয়ে মেরামত কাজ এখনো শুরুই হয়নি! ওদিকে ঠিকই ভুয়া বিল-ভাউচার জমা দিয়ে হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে বরাদ্দ করা সব টাকা ছাড় নিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিক্ষা কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে জমা রাখা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামতের এসব কাজ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির (এসএমসি) মাধ্যমে করার কথা। কিন্তু বিদ্যালয়গুলো কেনাকাটা না করেই দোকান থেকে ফাঁকা ভাউচার সংগ্রহ করে। এরপর তাতে প্রাক্কলন (এস্টিমেট) অনুযায়ী লিখে বরাদ্দের টাকা তুলে নেয়। আর এই ভুয়া ভাউচার তৈরিতে সহায়তা করেছেন খোদ উপজেলা শিক্ষা ও প্রকৌশলীর কার্যালয়ে কর্মরতরা।

শুধু তাই নয়, বিদ্যালয়ে মেরামত প্রয়োজন না থাকলে বা এলজিইডি কর্তৃক মেজর মেরামতের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান থাকলে বরাদ্দ পাওয়া অর্থ ব্যয় না করে সমর্পণ নিয়ম রয়েছে। একাধিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই নিয়মও মানা হয়নি।

বিজ্ঞাপন

উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য বরাদ্দ করা ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা দুই দফায় এসেছে। প্রথম দফায় ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। বাকি ৩৬ লাখ টাকা আসে চলতি বছরের ২২ মে। সব টাকাই ৩০ জুনের আগে বিভিন্ন সময় হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে ছাড় করানো হয়। ওই টাকা বরাদ্দ পাওয়া বিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাউন্টে না দিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ৯৭টি বিদ্যালয়ের অনুকূলে রুটিন মেইনটেন্যান্স বাবদ আসা মোট ৩৮ হাজার ৮০ হাজার টাকা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে ছাড় করিয়ে একই অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উপজেলা শিক্ষা অফিস ভবন মেরামত বাবদ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। অর্থবছর শেষ হয়ে গেলেও কোনো কাজ না করেই বিল তোলা হয়েছে। এছাড়াও রুটিন মেইনটেন্যান্স ও স্লিপের টাকা বিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাউন্টে না দিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে রেখে দিয়েছেন।

শিক্ষকরা আরও বলছেন, ক্ষুদ্র মেরামতসহ সব উন্নয়ন কাজে অফিস খরচ বাবদ ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। তা না হলে শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা কোনো কাগজে সই করেন না। এছাড়াও প্রকৌশল অফিসে প্রাক্কলন তৈরির জন্য খরচ দিতে হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (৪ জুলাই) ও মঙ্গলবার (৫ জুলাই) ক্ষুদ্র মেরামতের বরাদ্দ পাওয়া ২৫টি বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে কাজ শুরুই হয়নি। তবে সেগুলোতেও কাজ শেষ দেখিয়ে ৩০ জুনের মধ্যে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ অন্য সদস্যরা বরাদ্দের ব্যাপারে জানেনই না। তবে বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন একাধিক অভিভাবক। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ অনিয়ম উদঘাটনের দাবি জানিয়েছে তারা।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন অবশ্য কোনো ধরনের অনিয়ম-অভিযোগের কথা অস্বীকার করছেন। জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বরাদ্দের টাকা শিক্ষা কর্মকর্তার সরকারি অ্যাকাউন্টে আনার নিয়ম আছে। সেখান থেকে বিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাউন্টে দেওয়া হচ্ছে। আর শিক্ষা অফিস ভবন মেরামতের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ যথাযথভাবে খরচ করা হয়েছে।

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও অনেক বিদ্যালয়েই কাজ শুরু না হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রুহুল আমিন বলেন, বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি না থাকায় কাজ করতে দেরি হয়েছে। উপজেলা পরিদর্শন ও শিক্ষা কমিটির মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ তদারকি করা হবে।

কোনো বিদ্যালয়ে কাজ না হলেও তুলে নেওয়া বরাদ্দের টাকা কীভাবে সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘কাজ আদায় করে নেওয়া হবে। এখানে কোনো অনিয়ম হওয়ার সুযোগ থাকবে না।’ কাজ না করে ভুয়া বিল-ভাউচার দাখিল করে টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি সরকারি সিস্টেম। বাংলাদেশ সরকারের এই সিস্টেমটি ভুল। এটা নিয়ে আমি কথা বলতে পারব না।’

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ উত্তোলন ও ব্যয়ে অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন